প্রযুক্তিতে টেলিগ্রাফের প্রভাব
২৪ মে, ১৮৪৪; ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিনে আমেরিকার প্রথম টেলিগ্রাফ লাইনটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোরে পাঠানো হয় ইলেকট্রনিক বার্তা, ‘What hath God wrought’। যদিও ইংল্যান্ডে এর পূর্বে অন্য একটি টেলিগ্রাফ লাইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু আমেরিকায় স্যামুয়েল মোর্সের আবিষ্কৃত টেলিগ্রাফটিই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। সরল ডিজাইন ও তুলনামূলক কম খরচে অধিক কার্যকারিতার কারণে পরবর্তীতে এটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
টেলিগ্রাফ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে আসে। অন্য শহরের কোনো সংবাদের জন্য তখন আর ট্রেনের অপেক্ষা করতে হতো না। মুহূর্তের মধ্যেই সংবাদ পৌঁছে যেত দূর দূরান্তে। প্রথমদিকে মানুষকে টেলিগ্রাফের উপযোগীতা বোঝাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল মোর্সকে। তবে টেলিগ্রাফ লাইনটি প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে এ যন্ত্রটিকে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। সময়ের সাথে টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে জনতার ভিড় বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে টেলিগ্রাফ লাইনের চাহিদা।
বাজারের প্রচুর চাহিদার কারণে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এগিয়ে আসে টেলিগ্রাফের ব্যবসায়। গোটা আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এটি। একের পর এক টেলিগ্রাফের খুঁটি মাথা তুলতে থাকে, কিছু দূর পর পর দেখা দিতে শুরু করে টেলিগ্রাফ টার্মিনাল। ১৮৪৬ সালের শেষদিক পর্যন্ত গোটা আমেরিকায় টেলিগ্রাফ লাইন বলতে ছিল, নিউইয়র্ক থেকে বাল্টিমোরে ৪৪ মাইল দীর্ঘ সংযোগটি। এর দু’বছরের মাথায় টেলিগ্রাফ লাইনের দৈর্ঘ্য গিয়ে দাঁড়ায় ২০০০ মাইলে, আর ১৮৫৫ সালে এসে আমেরিকার ৪২,০০০ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে টেলিগ্রাফের সংযোগ।
মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আমেরিকার প্রায় সবগুলো জনবহুল এলাকা টেলিগ্রাফের আওতায় চলে আসে। টেলিগ্রাফ যে কেবল আমেরিকার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল তা নয়। এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছিল ইউরোপ জুড়েও। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশও যুক্ত হয়েছিল। তবে একটি বড়সড় চ্যালেঞ্জ তখনও রয়ে গিয়েছিল, তা হলো সাগরের দুই পাড়ের দুনিয়াকে সংযুক্ত করা। ১৮৫৮ সালে এসে তা-ও সম্ভব হয়ে গেল, টেলিগ্রাফের তার পাড়ি দিলো আটলান্টিক। সংযোগ স্থাপিত হলো আটলান্টিকের দুই পাড়ের দুই শহর নিউইয়র্ক ও লন্ডনের মধ্যে।
ট্রান্স-আটলান্টিক ক্যাবলের এ সফলতার সূত্র ধরে পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রের মধ্য দিয়েও টেলিগ্রাফের লাইন চলে গেল। বলা চলে কয়েক দশকের মধ্যে গোটা পৃথিবীর একটা বিশাল অংশ টেলিগ্রাফ লাইনের আওতায় চলে আসে। ১৮৭০ সালের দিকে তো লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্তও টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপিত হয়। বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করতে আগে যেখানে মাস পেরিয়ে যেত, টেলিগ্রাফের ফলে সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্ভব হয়ে ওঠে সে যোগাযোগ।
টেলিগ্রাফ ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির পথ ধরে, চাহিদার প্রেক্ষিতে টেলিগ্রাফে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোও বেশ দ্রুত উন্নতি লাভ করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রিলে। ইলেকট্রনিক যোগাযোগের কৌশলটি তখন ছিল একদমই সরল। তারের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল চলে যেত এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। কিন্তু এই দু’প্রান্তের দূরত্ব যখন অনেকটা বেড়ে যেত, তখন এ সিগন্যালের সক্ষমতা কমে যেত ও এর মূল আকৃতি বিকৃত হয়ে যেত।
এ সমস্যার সমাধানে জোসেফ হেনরি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি রিলে অসাধারণ ফল দেয়। সিগন্যালের যাত্রাপথে রিলে ব্যবহার করলে এটি দুর্বল সিগন্যাল পেয়েও এর থেকে পুনরায় মূল সিগন্যালটি তৈরি করতে পারতো। ফলে বহুদূর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব হয়ে ওঠে। রিলের এ উন্নতি টেলিগ্রাফের চাহিদার কল্যাণেই হয়।
একইভাবে টেলিগ্রাফ ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার কারণেই বৈদ্যুতিক তারের ক্ষেত্রে অসামান্য পরিবর্তন আসে। বাস্তবক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিতে গিয়ে তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বৈদ্যুতিক তার কতটা গুরুত্ব ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। স্বল্প দূরত্বে যে তার ঠিকঠাক কাজ করে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দেখা যায় তার রোধ বেড়ে যাওয়ার কারণে আর সিগন্যাল পাঠাতে পারে না। রোধ কমানোর জন্য মোটা তার ব্যবহার করলে তা আবার হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ব্যয়বহুল।
এ ধরনের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তাদের সঠিক পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হয়েছিল। প্রথমদিকে তারা ব্যবহার করতেন লোহার তার, যেগুলো খুব দ্রুতই ক্ষয়ে যেত; এছাড়া এগুলো ঠিকঠাকভাবে অন্তরিত (তারের ওপরে অপরিবাহী আস্তরণ) করা হতো না। এ তারগুলোর ব্যাসও হতো অসমান। টেলিগ্রাফের প্রয়োজনে সময়ের সাথে এ তারের রূপ বদলে যায়। বাজারে আসে বেশ ভালোভাবে অন্তরিত, নিম্ন ক্ষয়সম্পন্ন, সমমাপের কপার তার।
ট্রান্সআটলান্টিক ক্যাবল স্থাপনের সময় এই বৈদ্যুতিক তার আরো পরিপক্বতার দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমবার আটলান্টিকের দুই পাড়কে যুক্ত করা লাইনটি নষ্ট হয়ে যায় বৈদ্যুতিক তারের সমস্যার কারণেই। এতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়। তাই দ্বিতীয়বার যখন এ উদ্যোগ নেয়া হয় তখন বৈদ্যুতিক তার বা ক্যাবলের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করেন বিজ্ঞানীরা। এ টেকনিক্যাল টিমেরই একজন সদস্য গুস্তাভ কার্শফ টেলিগ্রাফ সিগন্যাল নিয়ে কাজ করার জন্য একটি নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে কার্শফের এ তত্ত্ব থেকেই আসে বর্তমান ইলেকট্রনিক ডিজাইনের মূল ভিত্তি ‘সার্কিট থিওরি’।
একই রকম উন্নতি ঘটে ব্যাটারির ক্ষেত্রেও। পূর্বে ব্যাটারি মূলত গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু টেলিগ্রাফের কল্যাণে ব্যাটারি বাজারে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন ব্যবসায়িক পণ্য হয়ে ওঠে। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে অতি দ্রুত এর প্রযুক্তিগত উন্নয়নও হতে থাকে। প্রাথমিক ভোল্টায়িক পাইলের পর আসে ড্যানিয়েল-সেল, এরপর আরো উন্নত সংস্করণ হয়ে আসে ড্রাই-সেল ও লেড-এসিড রিচার্জেবল ব্যাটারি। প্রতিটি ধাপে ব্যাটারি আরো শক্তিশালী ও সুবিন্যস্ত হতে থাকে।
তারপরও ব্যাটারির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলই, তাই ১৮৭০ সাল নাগাদ এসে কোম্পানিগুলো ব্যাটারির বদলে সদ্য আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক ডায়নামো বা জেনারেটর ব্যবহার করা শুরু করে টেলিগ্রাফ লাইনে শক্তি সরবরাহের জন্য। টেলিগ্রাফের প্রভাবে অন্যান্য আরো নতুন কিছু যন্ত্রও তৈরি হয়। এর মধ্যে একটি ছিল থমাস এডিসন উদ্ভাবিত টিকারিং টেপ।
টেলিগ্রাফকে ঘিরে তখন ইনফরমেশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। অর্থ-বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলো হালনাগাদ তথ্যের জন্য টেলিগ্রাফের ওপর নির্ভর করতো। যেমন, নিউইয়র্কের বাজারে তখন দ্রব্যমূল্য ও শেয়ারের দর বেশ দ্রুত ওঠানামা করতো। আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বিষয়ে সবসময় খবর রাখতে হতো। টেলিগ্রাফের পূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুতগতি সম্পন্ন কিছু বাচ্চাকে নিয়োগ দিত, যাদের একমাত্র কাজ ছিল যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়ে প্রতি মিনিটের হালনাগাদ তথ্য পৌঁছানো।
টেলিগ্রাফের আগমনের ফলে আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বাচ্চাদের দরকার হতো না। তার বদলে কোম্পানিগুলো শুধু এ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি টেলিগ্রাফ লাইনের ওপর ভরসা করতে শুরু করে। তরুণ উদ্ভাবক এডিসন এ জায়গায় একটি নতুন সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। তিনি এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করলেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাগাতার বিভিন্ন পণ্যের মূল্য সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য দিতে পারতো।
এটি তখন ‘টিকার টেপ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। টিকার টেপ বেশ দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। কোম্পানিগুলো পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকার টেপ স্থাপন করতে লাগলো আর এডিসন প্রথমবারের মতো আর্থিক সফলতার মুখ দেখলেন। এ ঘটনাটি থেকে এডিসনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করার গুণ ও উদ্ভাবনকুশলতার পরিচয়ও পাওয়া যায়।
এসব ছাড়াও টেলিগ্রাফের ফলে আরো অনেক ধরনের প্রযুক্তি বা সেবার বাস্তবায়ন হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল, টেলিগ্রাফের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুবিধা চালু। ১৮৭১ সালে, তখনকার বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন আর্থিক লেনদেনের এ সেবা চালু করেছিল। টেলিগ্রাফ না থাকলেও ‘টাকা তার করার’ এ সেবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো প্রচলিত আছে।
মূলত টেলিগ্রাফ যে কেবল যোগাযোগখাতেই এক বিপ্লব নিয়ে হাজির হয়েছিল তা নয়, এটি নিয়ে এসেছিল ‘ইলেকট্রনিক যুগ’ নামক এক নতুন যুগের আগমনী বার্তা। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এটি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগুলোকে পরিপক্ব ও সুবিন্যস্ত করে দিয়েছে। আর এর অসামান্য সফলতা এক নতুন সম্ভাবনার কাঠামো গড়ে দিয়েছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের ইলেকট্রনিক সভ্যতা।
তথ্যসূত্র
Conquering the Electron by Derek Cheung , Eric Brach , page (40-53)